অপরিচিতা ~ছোট গল্প [ স্বদেশ কুমার গায়েন ]
মেয়েটিকে প্রথম দেখেছিলাম এই বাসস্টপে। পরনে নীল কামিজ, কুচকুচে কালো চুল,চোখে একটা চসমা । বেশ ফর্সা ,এক কথায় অপরূপ সুন্দরী। বাতাসের দোলায় কপালের চুল গুলো যখন চোখের উপর এসে পড়ছিল, তখন হাত দিয়ে তা সরানোর ভঙ্গিটাই আমাকে যেন চুম্বকের মতো আকর্ষন করত। কম্পিউটার ক্লাস থেকে বেরিয়ে প্রতিদিন বাসের জন্যে এই বাসস্টপে অপেক্ষা করতে হয় আমার। সেদিনের এক বসন্তের বিকালে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। মেয়েটি এসে আমার থেকে কিছুটা দুরে দাঁড়াল। দু'চোখ সরাতে পারছিলাম না মেয়েটির দিক থেকে, কিন্তু পাবলিক প্লেসে এটা একটা অসভ্যতা, সেটাও মাথায় রাখতে হয়েছিল। তাই মাঝে মাঝে চোখ টা সরিয়ে নিচ্ছিলাম। মেয়েটি আমাকে খেয়াল করিনি। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো সে ও বাসের অপেক্ষা করছে কিন্তু বাস আসতেই,বাসে ওঠার জন্য কোনো তাড়াহুড়ো দেখালো না। একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। আমি কি করব! ভাবতে না ভাবতেই বাসটি ছেড়ে দিল । বাসটিকে আর থামতে বললাম না। এই প্রথম একটা মেয়েকে শুধু দেখার জন্য বাস ছেড়ে দিলাম। এক ভাবে দাঁড়িয়ে আছি আর মেয়েটিকে আড়চোখে দেখছি। বাস আসার এখনো দেরী আছে। বেশ কিছুক্ষন পর এক চল্লিষার্ধো ভদ্র মহিলা একটি স্কুটি নিয়ে মেয়েটির সামনে এসে দাঁড়াল। মেয়েটি পেছনে উঠে বসল ,মনে হয় মেয়েটির মা ই হবে। স্কুটি টির দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম, ঘোর কাটল যখন সামনে দিয়ে আমার বাড়ি যাওয়ার আরেকটি বাস চলে গেল। কোনোরকমে ছুটতে ছুটতে বাসটিতে উঠে পড়লাম।
এর পর থেকে প্রতিদিন মেয়েটির জন্য বাসস্টপে অপেক্ষা করি,সামনে দিয়ে বাস চলে যায়; তবুও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে দেখি। বেশ কিছুদিন , মেয়েটির চোখাচোখি হয়েছে কয়েকবার। তাকিয়ে থাকতে পারিনি তার চোখের দিকে। এতদিনে মেয়ে টিও হয়তো বুঝে গেছে, আমি তাকে আড়ালে দেখছি;– কারন মেয়েদের একটা ইন্দ্রিয় বেশী থাকে যেটা দিয়ে ওরা অনেক কিছু দেখতে পায়। আমার খুব ইচ্ছে করত,মেয়েটির সাথে কথা বলতে,ওর হাসি দেখতে,ওর সাথে হাঁটতে। কিন্তু কোনো দিন সাহস পায়নি।
একদিন ক্লাস থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছি বাসস্টপে। মেয়েটি এখনও আসেনি,কিন্তু এতক্ষন তো তার আসার কথা। আমি এদিক ওদিক দেখতে লাগলাম। আমার বাসটি সামনে দিয়ে চলে গেল। এই প্রথমবার এক অপরিচিতার জন্যে আমার মন কেমন করতে লাগল। অনেক সময় কেটে গেল, মেয়েটি আর এল না; আমার মন টা ভেঙে গেল। মনে মনে ভাবলাম, আজ হয়তো আসেনি,বাড়িতেই আছে। কাল নিশ্চয় আসবে। হাতের ঘড়ির দিকে তাকালাম। বাস আর কিছুক্ষনের মধ্যেই আসবে। বাস এলো না।
একটা স্কুটি এসে থামল আমার সামনে। স্কুটি আরোহীর পরনে জিনস আর টিশার্ট,মাথায় হেলমেট। গলার স্বর শুনে নিশ্চিত হলাম সে মেয়ে,–" বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন?" আমি ওতটা খেয়াল করিনি। আমার চোখ এখনও এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, মেয়েটির জন্যে।
– "ওই, হ্যালো ! আপনাকে বলছি!"
–" বলুন।"
-"বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন?"
আমি বললাম, -"হ্যাঁ।"
-"আমার স্কুটি তে বসুন, আমি তো ওদিকেই যাব।"
এ কি মেয়েরে বাবা! এতদিন জানতাম,মেয়েরা রাস্তায় একলা দাঁড়িয়ে থাকলে, ছেলেরা আগবাড়িয়ে লিফট দিতে যায়। আর আজ একটা মেয়ে এসে....! মনে মনে ভাবলাম, এ মেয়েদের ইভটিজিং এর নতুন পদ্ধতি না তো? বাসস্টপে আমাকে একলা পেয়ে..... ইভটিজিং করছে না তো !
-"কি ভাবছেন? মেয়েদের স্কুটি তে উঠতে ভয় না লজ্জা পাচ্ছেন?"
এবার একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। আমার সন্মান, সাহসিকতা নিয়ে টানাটানি। যদিও বরাবরই আমি একটু ভীতু। মেয়েদের একটু বেশি ভয় পাই। কিন্তু সেটা কাউকেও বুঝতে দেই না। আস্তে আস্তে স্কুটির পিছনের সিটে গিয়ে নিদিষ্ট দূরত্ব রেখে বসলাম। ভাল লাগছিল না আমার,বার বার মেয়েটির কথা মনে পড়ছিল। কিছু হল না তো ওর! স্কুটি টি আমার বাড়ির রাস্তা না গিয়ে অন্য একটি রাস্তা ধরল।
– "আরে আমার বাড়ি এই রোডে। ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন?"– আমি বললাম।
—"চুপ করে বসুন তো মশাই। ওদিক দিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি পৌছে যাব, তাই এ রোড দিয়ে যাচ্ছি।"
এবার আমার কেমন ভয় করতে লাগল। মেয়েটির মতলব কি? শেষে ক্লাবের দাদা দের দিয়ে মার খাওয়াবে না তো! একটু ধীরে ধীরেই স্কুটি চালাচ্ছে মেয়েটি। সামনের আয়নাতে শুধু চোখ দুটি দেখা যাচ্ছে তার। দশ মিনিটের রাস্তা, পঁচিশ মিনিট ঘুরিয়ে শেষ পর্যন্ত আমার বাড়ির গেটের সামনে পৌছে স্কুটি টাকে থামাতে বললাম।
স্কুটি থেকে নেমে বললাম,-" ধন্যবাদ।"
মেয়েটি জিজ্ঞেস করল,— "আমার স্কুটি তে উঠতে চাইছিলেন না কেন?"
-"না, মানে.... অপরিচিত কারও স্কুটি তে উঠতে আমার ভয় করে। "
– "ও তাই বুঝি! আর , বাসস্টপে রোজ রোজ একটা অপরিচিত মেয়ের জন্য অপেক্ষা,তার দিকে তাকিয়ে থাকতে, আপনার ভয় করে না?"
চমকে উঠলাম আমি। মেয়েটি মাথা থেকে হেলমেট টা খুলল। আমি যেন স্বপ্ন দেখছি, কি বলব ভেবে পেলাম না; এ তো সেই মেয়েটিই। যাকে প্রতিদিন বাসস্টপে দেখি।
মেয়েটি স্কুটি স্টার্ট দিয়েছ। আমি বললাম– "এই একটু দাঁড়াও। তোমার নাম কি?"
মেয়েটি দূর থেকে হেসে বলল,—" কাল বাসস্টপে বলব, কেমন! "
স্বদেশ কুমার গায়েন (২০১৫)
Darun
ReplyDelete