কালো মেয়ের গল্প ~ ছোট গল্প [ স্বদেশ কুমার গায়েন ]
সকাল বেলা বিছানার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পা দু টো হাঁটু থেকে ভাঁজ করে দোলাতে লাগল শুভা। হাতের আঙুল টা সামনে রাখা ল্যাপটপের টাচপ্যাডের উপর অনিদিষ্ট ভাবে চক্কর কাটছে। ফেসবুক টা খোলাই আছে, অনেকক্ষন থেকে। কাউকে ম্যাসেজ পাঠাতে ভাল লাগছে না। ফেসবুকে তার কত বন্ধু! কিন্তু তবুও যেন মন খারাপ।পয়েন্টার টা লগ আউটের উপর নিয়ে গিয়ে একটা ক্লিক করল শুভা। ল্যাপটপ টা বন্ধ করে ফোন টা হাতে নিয়ে হোয়াটঅ্যাপস এ ডুকলো। না! কেউ অনলাইনে নেই। চেনা জানা বন্ধু কে কয়েকটা ভুল ভাল ফোটো সেন্ড করে ফোন টা ছুড়ে ফেলে দিল একপাশে। তারপর কোল বালিশ টা কোলের মধ্যে টেনে নিল।
কিছুই ভাল লাগছে না তার। - বোন টা কোথায় গেল? একটা ফোন আসতেই উঠে বাইরে চলে গেল মেয়েটা, এখনো আসার নাম নেই।
শুভার দিন রাতের সঙ্গী বলতে তার বোন রিয়া। ভাল নাম রিয়াশ্রী। শুভা আদর করে রিয়া বলে ডাকে। রিয়া ওর নিজের বোন নয়। ওর মামাতো বোন। সেই ক্লাস নাইন থেকে ওদের বাড়িতে থেকেই পড়াশুনা করে।— মেয়ে টা তো এখনো এল না! কি জানি বাবা! নতুন প্রেম ট্রেম করছে নাকি? মনে মনে বলল শুভা।
শুভার খুব ইচ্ছে করে কাউকে ভালবাসতে। মনে মনে ভাবে তার একটা বয় ফ্রেন্ড থাকবে , তাকে সব সময় আদর করবে, তার হাত ধরে ঘুরবে। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠেনি কখনো। কি করে হবে? তার মতো এমন, কালো , দেখতে খারাপ মেয়েকে কে ভালবাসবে? আজ পর্যন্ত সাদা, কালো কোনো ছেলেই তার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসেনি। লক্ষ্য তাদের অন্যদিকে থাকে। আয়নায় নিজেকে দেখতে যেন ভয় পায় শুভা। দুহাতে নিজের মুখটা চেপে ধরে। নিজেকে কত ভাবে সাজিয়ে রাখার চেষ্টা করে, তবুও নিজের মনের মতো কখনই হয়ে উঠতে পারে না।
— বোন টার তো কোনো সাড়া শব্দ নেই! বিছানা থেকে উঠে দরজা দিয়ে বারান্দায় উঁকি মারে শুভা। বারান্দার একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে রিয়া। ফোনটা কানে ধরা, মুখটা হাসি হাসি। হঠাৎ ফোনটা কান থেকে নামিয়ে মুখের কাছে আনে, তারপর ফোনের উপরি ছ্যাটা ছ্যাট পাঁচ ছয় টা চুমু খায়। চমকে উঠে শুভা,বোনের কান্ড দেখে। কি করছে এসব! নিশ্চয় ফোনের ওপারে ওর বয়ফ্রেন্ড ছিল!
বিছানার উপর এসে আবার এলিয়ে পড়ে শুভা। তার থেকে পাঁচ বছরের ছোটো, এখনো কলেজ টা শেষ করতে পারিনি। এখনিই এতদুর! আজ মা, বাবা বাড়িতে নেই ; সেই জন্যেই মেয়েটা এতদুর এগিয়েছে।
শুভা জানে প্রতি রবিবার মা, বাবা তার জেঠু দের বাড়িতে যায়, তার সম্বদ্ধ দেখতে। স্বাভাবিক! মেয়ে বড় হলেই, প্রত্যেক বাবা মায়ের একটা দায়িত্ব থাকে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার। কিন্তু কোনো পাত্র পক্ষ তো তাকে দেখলেই পছন্দ করতে চায় না। তার মতো কালো চেহারার মেয়েকে কে পছন্দ করবে বলুন?
একবার একটা পাত্রপক্ষ শুভাকে দেখতে তাদের বাড়িতে এসেছিল। ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের ইংরাজি পড়ায়। ছেলের মা ভুরু কুঁচকে পণ হিসাবে তার দর তুলে প্রায় আড়াই লাখ টাকা। সরকারি চাকরী করা ছেলে টা মায়ের পাশে ভোদাইয়ের মতো মাথা নীচু করে বসেছিল। শুভার খুব ইচ্ছে করছিল পা থেকে জুতোটা খুলতে,— স্কুলে গিয়ে স্ট্রাগল এগেনেস্ট ডাউরি ( The struggle against dowry)পড়াবে আর এখানে এসে বোবার মতো বসে থাকবে।
শুভার বাবা সেদিন অসহায়ের মতো বলেছিল, — "আমার মেয়ে খুব ভাল.....ভাল গান করতে পারে।"
হ্যাঁ,এই একটা জিনিষ শুভার খুব প্রিয়। তার গানের গলার প্রসংশা সবার মুখে । বাবার অসহায় মুখটা দেখে সেদিন শুভার খুব কষ্ট হয়েছিল। নিজের উপর ঘেন্না হতে লাগল। সুসাইড করতে চেয়েছিল কিন্তু বাবা-মায়ের মুখ চেয়ে সেটা পারি নি। দুপুরে বোন কলেজে গেলে চুপি চুপি আনন্দবাজারের পাত্র পাত্রী পেজ টা দেখে শুভা,- যদি কাউকে পাওয়া যায়। কিন্তু এখানেও মেলে না। হাঁদা, ভোদা,ভুতো, বুড়ো, কালো, হ্যাংলা মুখো কত্ত রকম ছেলের ছবি। কিন্তু সব শালার ফর্সা মেয়ে দরকার। রাগে কাগজ টা ছিঁড়ে জানালা দিয়ে ফেলে দেয় শুভা। টিভি তেও যত অ্যাড দেখায়, সব ঢপ- কই সে তো এত কিছু ফর্সা হবার ক্রিম ব্যবহার করছে, কিছুতেই কিছু হয়নি তো!
কোল বালিশ টাকে বুকে জড়িয়ে খুব কাঁদতে ইচ্ছা করে শুভার। রিয়া কখন যে পাশে এসে বসেছে খেয়াল করিনি সে। রিয়ার ফোনের উপর কিস করার কথাটা মনে পড়ে যায়। একটা দিদি দিদি ভাব নিয়ে শাসনের সুরে বলে,— "ছেলেটি কে?"
— "কোন ছেলেটি!" রিয়া বিস্ময় ভাব নিয়ে বলে।
— "আমি কিছু জানি না ভেবেছিস?ওই বাইরে গিয়ে ফোনের ভেতর দিয়েই চুমু টুমু করলি।"
রিয়ার মুখটা শুকিয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে, - "না, মানে! ও আমার বয়ফ্রেন্ড আর কি।"
- "কই, বলিস নিতো আমাকে! একটা ফোটো দেখা?"
ফোন থেকে সেলফি মোডের একটা ফোটো বের করে দিদিকে দেখায় রিয়া। ফোটো দেখে শুভার বুক টা যেন কেঁপে ওঠে। রিয়ার ঠোঁটের ভেতর ছেলেটি তার ঠোঁট টা যেন ডুবিয়ে দিয়েছে।
- "কি করেছিস তোরা? চুমু খাওয়ার পাঠ শেষ!" শুভার চোখে মুখে বিস্ময়।
রিয়া মুচকি হাসে।
— "দাঁড়া, মাকে আমি বলছি।"
শুভার গলাটা জড়িয়ে ধরে রিয়া। — "দিদি প্লীজ বলো না। প্লীজ! প্লীজ! চুমু খাওয়ায় যে কি মজা তুমি জানো না।"
- 'বাঁদর মেয়ে খুব বড় হয়ে গেছিস না? দুষ্ট দুষ্ট কথা বলতে শিখেছিস।"
মাঝে মাঝে রিয়ার উপর খুব ঈর্শ্বা হয় শুভার। ওর থেকে পাঁচ বছরের ছোটো হলেও রিয়ার বয়ফ্রেন্ড আছে। কলেজ কেটে ঘুরতেও যায় মনে হয়। তার মতো কালো নয়, অনেক ফর্সা; অনেক সুন্দর দেখতে। সত্যিই তো! চুমুতে কি মজা আছে সে জানে না। কি করে জানবে সে? তার এই কালো চামড়াতে কে ঠোঁট ছোঁয়াবে? এই সব কথা ভাবলে মন খুব ভারী হয়ে ওঠে শুভার। বার বার মরে যেতে ইচ্ছে করে।
সন্ধ্যায় মা এসে খবর দেয় একটা সম্বদ্ধের সন্ধান পাওয়া গেছে। ছেলে রেলে চাকরী করে। ট্রেনের টিকিট পরীক্ষক— মানে টি.টি.। পরের রবিবার শুভাকে দেখতে আসবে। এসব আর পছন্দ হয় না শুভার। নিজেও যে খুব একটা খারাপ স্টুডেন্ট তা নয়, মাস্টার ডীগ্রী কমপ্লিট করা আছে। চাকরীর চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে। যেকোনো একটা চাকরী পেয়ে গেলেই আর কোনোদিন বিয়ের কথা ভাববে না। বাবা মাকে নিজের যত্নে রাখবে সারাজীবন। প্রয়োজনে না হয় লিভ টু গেদার করবে। কিন্তু কোনোদিকেই কিছু হয়ে উঠছে না।
পরের রবিবার পাত্রপক্ষ দেখতে এল শুভা কে। ছেলে, আর তার বাবা, মা, পিসী। ছেলেটিকে বেশ মনে ধরল শুভার। মন্দ নয় ছেলেটি, বেশ হাসি খুসি; মিশুকে টাইপের। বয়ষ আঠাশের কাছাকাছি বা একটু বেশি হবে। খুব ফর্সা না হলেও তার মতো অতো কালো নয়। সবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলে। এই প্রথম কোনো ছেলে শুভার কালো মুখটার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল এবং তাকে একটা গান গাওয়ার অনুরোধ জানাল । শুভার বাবা যেন খুব খুশি হল। স্কুল, কলেজে, বিভিন্ন জায়গায় শুভা গান করেছে। কিছু মনে হয়নি কোনোদিন। কিন্তু আজ তার কেমন লজ্জা করতে লাগল। অনেক কষ্টে গান টা শেষ করল শুভা। শুভার গান শুনে পাত্রটিকে যেন খুব খুশি মনে হল। জল খাবার খেয়ে টেয়ে ছেলে মা বললেন, আমরা ফোন করে জানিয়ে দেবো। পাত্র নিজে তার ফোন নাম্বার দিয়ে গেল শুভার বাবার কাছে। শুভার আপত্তি সত্বেও তার একটা ছবিও নিয়ে গেল ছেলেটি।
অনেক দিন পর শুভার বাবা-মাকে বেশ হাসি খুশি দেখাচ্ছে। শুভা কে দেখে পাত্রপক্ষের নিশ্চয় পছন্দ হয়েছে! এবার শুধু ফোনের অপেক্ষা!
অবশেষে দু দিন পর রাতে খাওয়ার সময় সেই বহুপ্রতীক্ষিত ফোন টা এল। শুভার বাবা উঠে গিয়ে ফোন টা ধরল। পাত্রের নাম্বার! ওপার থেকে ছেলের মার গলার আওয়াজ
— "দেখুন,আপনাদের মেয়ে খুব ভাল। কিন্তু ছেলের মামাদের এ বিয়েতে একটু অমত আছে। কিছু মনে করবেন না.....প্লিজ !"
শুভার বাবা কোনো কথা বলতে পারল না। অসহায় ভাবে ফোন টা রেখে দিল। সেদিন রাতে ভাতের থালা রেখে কাঁদতে কাঁদতে উঠে গিয়েছিল শুভা। রাতে বোন কে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল । আর ডিসিসান টা রাতেই নিয়েছিল। সুসাইড! বেঁচে থেকে কি লাভ?এ ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই।
সকাল বেলা রিয়া টিউসনএ বেরিয়ে গেলে একটা ভাল করে সুসাইড নোট লিখল শুভা। কোথায় মরবে সেই জায়গার নামটাও লিখে দিল নোটে,- অন্তত বাবা মা যেন জানতে পারে তাদের মেয়ে কোথায় মারা গেল।
নিউ গড়িয়া মেট্রোস্টেশন! সব থেকে ভাল জায়গা সুসাইডের পক্ষে। রেলের ট্রাকের কারেন্টে পা দিলেই এক সেকেন্ডে সব পুড়ে শেষ। সকাল ন'টায় কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল শুভা। ব্যারাকপুর থেকে শিয়ালদহ ট্রেনে ঘন্টাখানেক রাস্তা, তারপর শিয়ালদহ থেকে নিউ গড়িয়া কুড়ি মিনিটের মতো। এগারোটার মধ্যে মোটা মুটি পৌঁছে যাবে সে। রিয়ার টিউসন পড়ে ঘড়ে ঢুকতে এগারোটা বেজে যাবে, তারপর সে সুসাইড নোট টা দেখবে; আর সবাই মিলে নিউ গড়িয়া পৌঁছাতেই পৌঁছাতে ততক্ষনে খেলা শেষ।
পরিকল্পনা মতো নিউ গড়িয়া স্টেশনে নেমে, মেট্রোর প্লাটফর্মে ঢুকলো শুভা। প্লাটফর্ম টা ফাঁকা ফাঁকা যেন। দুরে কয়েক জন আর. পি.এফ. ফোনে কিসব দেখছে আর নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে। পরিবেশ টা একদম সুসাইড করার পক্ষে উপযুক্ত। রেলের ট্রাকে নামার আগে একবার এদিক-ওদিক তাকালো শুভা। যদি আর.পি.এফ. দেখে ফেলে? যদি ঠিক ট্রাকে পা না দিতে পারে? আরেকটা বুদ্ধি এল তার মাথায়,— তার থেকে ট্রেনের সামনেই ঝাঁপ দিলে কেমন হয়! যদি ও কারেন্টে মিস হয়ে যায়, তবু মেট্রো রেল গাড়ির চাকা তাকে পিষে দিতে পারবে।
প্লাটফর্মে ট্রেন ঢোকার অপেক্ষা করতে লাগল শুভা। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ মধ্যে ফোনটা বেজেই চলেছে। সেদিকে কোনো খেয়াল নেই শুভার। তবুও একবার মরার আগে দেখতে ইচ্ছে হল কে কে তাকে ফোন করেছে। ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করল,— রিয়ার পাঁচটা, বাবার ছ'টা, আরেকটা অচেনা নাম্বার থেকে দশ টা মিসড কল। ফোন টা ব্যাগে ঢুকিয়ে হাতের ঘড়ির দিকে চাইল শুভা— এগারো টা বেজে পনেরো মিনিট।
প্লাটফর্মে একটা ট্রেন ঢুকছে। চির মুক্তি!- শুভার চোখে জল চলে এল । শেষ বারের মতো বাবা, মার মুখটা মনে করল,আর সেই সাথে অচেনা ছেলেটির যে, তার কালো মুখটা দেখে প্রথম বার হেসেছিল। মনে মনে সে পছন্দ করে ফেলেছিল ছেলেটিকে। ট্রেন টা খুব কাছে এসে পড়েছে। ব্যাগে ফোন টা ক্রমাগত বেজেই চলেছে। ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিতে যাবে এমন সময় পিছন থেকে কেউ যেন তার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। হাত ধরে টেনে থামের আড়ালে নিয়ে গেল তাকে।
মাথা ঘুরছে শুভার। নিজের চোখ কে ও বিশ্বাস হচ্ছে না কিছুতেই। এ তো সেই ছেলেটি! এই রবিবার যে তাকে দেখতে এসেছিল। কিছু বলতে যাচ্ছিল শুভা।বলতে পারলো না। তাই আগেই ছেলেটি তাকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে টেনে নিল। -" কি পাগলামো করছো! আমি তোমাকেই বিয়ে করবো।" বলল ছেলেটি।
সারা শরীর কাঁপছে শুভার। একটা ভালোলাগা, ভালোবাসা তার সমস্ত শরীরটাকে অবশ করে তুলছে। অনেকদিন ধরে যেটার প্রতীক্ষায় সে রয়েছে।
স্বদেশ কুমার গায়েন (২০১৫)
Comments
Post a comment