আমার অদ্ভূত যত শখ ~ স্বদেশ কুমার গায়েন
শখ জিনিষ টা বড়ই অদ্ভূত। অনেকটা নেশার মতো মাদকতা ঢেলে দেয় মনের মধ্যে। একটা আনন্দের শিহরন জাগায় মনের কোনো।শখের বসে মানুষ কত কি যে করে ফেলতে পারে, তার কোনো দিশা নেই। আর শখের জিনিষ হারিয়ে গেলে? এর থেকে মনে হয় বেশি কষ্ট মানুষ আর পায় না।
আমার যেমন শখের কোনো অন্ত ছিল না। অদ্ভূত অদ্ভূত সে সব শখ। বিভিন্ন জিনিষের প্রতি বার বার আকর্ষিত হয়েছি আমি। আর শখের জিনিষ হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রনা-দু:খ বার বার অনুভব করেছি।কোনো দামি জিনিষ হারিয়ে গেলে, এতটা কষ্ট আমি বোধহয় অনুভব করেনি। ছোটো বেলায় যেমন একসময় ফুলের বাগান তৈরী করার নেশা চেপে বসেছিল। কি অদ্ভূত সে নেশা! নানা জায়গা ঘুরে ঘুরে ফুলের চারা সংগ্রহ করে বাড়িতে এনে একটা নিদির্ষ্ট জায়গাতে লাগানো। কত রকমের গাঁদা ফুল, জবা ফুল, ঘাস ফুল, বেল ফুল, অপরিজিতা, টগর, মোরগজটা, দোপাটি...। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই জল বালতি আর মগ টা নিয়ে বাগানে চলে যাওয়া। তারপর সেই গাছে ফুল ফুটলে এক অনাবিল আনন্দে শিহরন জাগতো মনে। কিন্তু একদিন এক ছাগলে, সব লোপাট করে দিল। কষ্ট হয়েছিল সেদিন।
তখন আমার বয়েস অনেক কম। হঠাৎ একদিন বাজনা বাজানোর শখ চাপলো আমার মাথায়। আমার বাড়িতে কোনো মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্ট কোনো কালেই ছিল না। তাই কোনো কিছু না পেয়ে শেষ পর্যন্ত রান্না ঘরের থালা ঘটি , গ্লাস, মুড়ির কৌটা সব ভেঙে চুরে তচনচ করে ফেললাম। সারাদিন ড্রামের মতো সামনে সেগুলো সাজিয়ে রেডিওতে গান চালিয়ে বাজাতে শুরু করতাম।সে এক যাচ্ছেতাই অবস্থা! মা তো আমার বাজানোর ঠেলায় অস্থির হয়ে গেল। একদিন বলল, আমাকে তবলা বাজানো শিখাতে ভর্তি করে দেবে। ব্যাস! ভয় পেয়ে গেলাম আমি। আমার বাজানোর শখ চলে গেল।
এরপর একটু একটু করে বড় হতেই, ছবি আঁকার শখ, বিভিন্ন লেখকের স্কুল বই সংগ্রহ করে রাখার শখ হল। নানা ক্লাসের, পুরানো, নতুন সব ধরনের বই এনে সাজিয়ে রাখতাম। অনেক অনেক পুরানো দিনের বই ছিল আমার কাছে। আমার বাবা, কাকু যখন স্কুলে পড়তো সেই সময়কার। কিন্তু সেটাও ভাগ্যে থাকলো না। একদিন উঁইপোকাতে সব বই কেটে দিল। সেদিনও কষ্ট হয়েছিল খুব। এরপর একটু করে বড় হয়ে গেলাম। হাতে মোবাইল এল। আবার নতুন একটা শখ দেখা দিল আমার মধ্যে। ইন্টারনেট থেকে গান সংগ্রহ করে মেমোরি কার্ডে রাখা। এমনিতেই আমি গান পাগল মানুষ। তাই এরকম শখ থাকাটাই স্বাভাবিক। যত পুরানো, নতুন যুগের গান সব ডাউনলোড করে মেমোরি কার্ডে সংগ্রহ করে রাখতে লাগলাম। সেই কোন যুগে গাওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের গলায় গাওয়া রবীন্দ্র সংগীত থেকে শুরু করে এ যুগের বাংলা ব্যান্ডের গাওয়া রবীন্দ্র সংগীত, হিন্দি ভার্সানে গাওয়া রবীন্দ্র সংগীত - নানা ধরনের গান সব সংগ্রহ করে রাখতাম। হঠাৎ একদিন এখানেও দু:খের ছায়া নেমে এল। আমার মেমোরি কার্ড টাই ফরম্যাট হয়ে গেল। এর পর থেকে আমি আর দু:খে সেই ভাবে গান সংগ্রহ করেনি।
তবে আমার যে শখের জন্যে বাড়ির লোক সমস্যায় পড়েছিল,এবার সেই গল্প টাই বলবো। তখন আমি যতেষ্টই বড়। ক্লাস ইলেভেনে পড়ি। বাড়িতে খবরের কাগজ আসতো। আর সেই খবরের কাগজে যত ক্রিকেট ফুটবল প্লেয়ার দের ছবি দেওয়া থাকতো- সব কেটে কেটে আমার একটা খাতায় আঁঠা দিয়ে সাঁটতে শুরু করলাম।একটা খাতা শেষ হলে আরেকটা।খাতা ফুরোলে আমার ঘরের দেওয়ালে। সমস্ত ক্রিকেট খেলার রের্কড, তথ্য, সব কেটে সংগ্রহ করে রাখতে শুরু করলাম। দেশি- বিদেশী সমস্ত খেলোয়াড়দের ছবি।অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন ক্রিকেটার রিকি পন্টিং এর বিশাল বড় ভক্ত ছিলাম আমি। আমি যদি কারও ফ্যান হই, তবে একমাত্র ওনার। খবরের কাগজ থেকে শুরু করে খেলার পত্রিকা, যেখানে যত রিকি পন্টিং এর ছবি পেতাম,সব কেটে এনে খাতায় মেরে রেখে দিতাম। একটা মোটা খাতা হয়ে গেল সম্পুর্ন রিকি পন্টিং এর। আর অন্য একটা খাতা হয়ে গেল বাকি প্লেয়ারদের।
অদ্ভূত এরকম শখের জ্বালায় সমস্যায় পড়ল আমার বাড়ির লোক। আমার ঠাকুরদার পুরানো খবরের কাগজ পড়ার অভ্যেস ছিল। বসে বসে সব সময় পুরানো কাগজ পড়ত। ব্যাস! আমার শখের ঠেলায় কাগজ সব ফালা ফালা। কি পড়বে এখন?
সবথেকে সমস্যা হল মাসের শেষে গিয়ে। সারা মাসের সমস্ত জমানো খবরের কাগজ এক জায়গায় করে মাসের শেষে ফেরিওয়ালার কাছে বিক্রি করে দেওয়া হত। সেটা খবরের কাগজের টাকা মেটানোয় কাজে দিত।কিন্তু ফেরিওয়ালা কেন, এইরকম কাটা-কুটি কাগজ নেবে? সে ব্যাটা বসতো বেঁকে। আর বাড়ির সবার সব রাগ গিয়ে পড়ত আমার উপর। বকাবকি করতে শুরু করতো। কিন্তু সে সব আমার কানে ঢুকতো না। তখন একটা নেশায় পড়ে গেছি। সেই আবার নতুন কাগজ এলে, পেপার কাটিং শুরু হয়ে যেত। ওই যে আগেই বলেছিলাম না, শখ জিনিষ টা বড়ই অদ্ভূত। শখের জিনিষের জন্যে হাসিমুখে বকাবকি ও খাওয়া যায়।
-----------------
স্বদেশ কুমার গায়েন ( ২০১৭)
Comments
Post a comment