চেজ~ছোটোগল্প [ স্বদেশ কুমার গায়েন ]
মেয়েটি থমকে দাঁড়ালো। বেশ কিছুক্ষন একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইল।একটু আগেই ধীর লয়ে, কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটছিল মেয়েটি।কাঁধে একটা ছোটো ব্যাগ। তারপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল মেয়েটি। অগত্যা আমিও থেমে গেলাম। এই মুহুর্তে আমার থেকে প্রায় হাত পঁচিশ দূরে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে পিছন ফিরে। রাতের নির্জন ফাঁকা রাস্তা। একটাও মানুষজন,গাড়ি-ঘোড়ার দেখা নেই।
শুনসান। যদিও মূল শহর থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন এই রাস্তাটি। তাই লোক চলাচল একটু কম থাকে। হাতের ঘড়ির দিকে তাকালাম।রাত দশটা বাজে। এর আগেও অনেকবার এ রাস্তায় আমাকে আসতে হয়েছে। দু'পাশে কয়েকটি ল্যাম্পপোস্টের ছায়াময় আলো।বেশ একটা আলো আঁধারি পরিবেশ। একটা মেয়েকে রেপ করে খুন করার পক্ষে উপযুক্ত জায়গা। তবে এদিকটায় বেশির ভাগ ল্যাম্পপোস্টের অালো নেই। রাত নামলেই এই রাস্তাটা মাতালদের আখড়া তৈরী হয়।এসব কাজ তাদেরই।মেয়েটি দুপাশে তাকায়।মনে হয়,কাউকে খোঁজ করতে থাকে। এর থেকে আর ভালো সুযোগ হয় না! খুব সন্তর্পণে আরও কয়েক পা এগিয়ে যাই মেয়েটির দিকে। আরও তিন জন আসার কথা আছে..........।
মেয়েটিকে বাসের ভেতর দেখেছিলাম ঘন্টা দেঢ়েক আগে। মেয়ে না,বউ? পরনে কালো শাড়ি, সাদা হাফ হাতা ব্লাউজ।বুকের ক্লিভেজ স্পর্ষ্ট দেখা যাচ্ছে।ফর্সা পেটের উপর নাভি টা উন্মুক্ত। প্রথমে ভেবেছিলাম বউ হবে। কিন্তু পরে ভাল করে দেখে বুঝলাম,বউ নয়-মেয়ে। আসলে শাড়ি পড়া মেয়ে দেখলে আমি বউ ভেবে বসি। মেয়েটির বয়ষ খুব বেশি নয়-পঁচিশ কি ছাব্বিশ। পেট্রোল পাম্প টা পেরিয়ে,বড় শিরিশ গাছের নীচে বাস টা থামতেই মেয়েটি উঠেছিল। আর উঠেই আমার সামনের সিটে জানালার পাশে বসে পড়ে। পিছন ফিরে একবার আমার দিকে তাকায়। মুচকি হাসলো কি?
হতেও পারে।আমার ঠিক সেইরকম মনে হল। আমার বুকের ভেতর টা একটু কেঁপে উঠে যেন। ঘড়িতে এখন সাড়ে আট টা বাজে। মধ্যম গতিতে বাসটি চলছে। দুপাশে অটো,ট্রেকার,লরি গুলো দ্রুতো গতিতে ওভারটেক করে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমার অত ব্যস্ততা নেই। যত রাত হবে তত ভাল। তাই বাস কোন গতিতে চললো,তা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। মাঝে মাঝে মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছি,আর জানালা দিয়ে বাইরে চোখ রাখছি। রাতের আকাশে বড্ড বেশি তারা ঝিকিমিকি করছে।
-"দিদি,ভাড়াটা!" বাসের কনডাক্টর এসে মেয়েটির কাছে ভাড়া চায়।
-"কলেজ মোড়।একটা।"মেয়েটি তার
কাঁধে ঝোলানো ছোটো ব্যাগের ভেতর থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে, কনডাক্টরেরর হাতে দেয়।
এক ঘন্টা পর কলেজ মোড় আসতেই,আমিও মেয়েটির সাথে বাস থেকে নেমে পড়ি। বাস চলে যায় ধুলো উড়িয়ে। রাতে অবশ্য সে ধুলো দেখা যায় না। এই মোড় থেকে সোজা রাস্তা টি চলে গেছে কলেজের দিকে। রাত সাড়ে ন'টা বাজে। বেশ কিছু দোকান পাট এখনো খোলা আছে। কেউ কেউ আবার ঝাঁপ বন্ধ করে দেওয়ার তোড় জোড় করছে। মেয়েটি বাস থেকে নেমে এদিক- ওদিক তাকায়। অনির্দিষ্ট ভাবে কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি করে। আমি মেয়েটির কাছ থেকে কিছুটা সরে যাই। একটা দোকানের ভেতরে ঢুকি। এক প্যাকেট সিগারেট কিনি। লাইটার আমার কাছে সবসময় থাকে। তাই ওটা কেনার দরকার পড়ে না। দোকানের বাইরে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরাই।হালকা ধোঁয়া ছাড়ি।
মেয়েটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে।বেশ কিছু সময় পর মেয়েটি সোজা রাস্তা ধরে কলেজের দিকে হাঁটা শুরু করে। আমি সিগারেট টা মুখ থেকে নীচে ফেলে,পা দিয়ে কয়েকবার চাপ দিই। সিগারেটের আগুন নিভে যায়। তারপর নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে মেয়েটিকে অনুসরন করি। পিছনের দিকে না তাকিয়ে,মেয়েটি নিজের মতো হেঁটে চলে। এদিকের রাস্তাটা অতটা নির্জন নয়। এখনো পথ চলতি লোকের আনাগোনা।কিছুটা দুরে একটা ক্লাবঘর চোখে পড়ে। বারান্দায় একটা লাইটের নীচে ক্যারমবোর্ড রাখা। সেখান থেকে পাড়ার ছেলেদের চেঁচামেচি শোনা যায়। মেয়েটি ক্লাবের পাশে গিয়ে একটু থামে। বড় রাস্তাটি থেকে একটা ভাঙা পিচের রাস্তা ক্লাবের পাশ দিয়ে ডান দিকে নেমে গেছে।মেয়েটি এবার সেই রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করে। আমিও মেয়েটির পেছন পেছন সেই রাস্তায় নেমে পড়ি। মেয়েটি আমাকে দেখেছে কি? মনে মনে আমার প্রশ্ন জাগে।
দেখলেও বা কি ক্ষতি! আরও পাঁচ মিনিট হেঁটে চলে মেয়েটি।সাথে আমিও। মনে মনে এবার বিরক্ত হই। ঠিকঠাক জায়গা টা এখনো আসছে না! আমার আর তর সইছে না। বাড়ি-ঘর খুব একটা নেই এদিকটায়।শহুরে পরিবেশ থেকে একটু বিচ্ছিন্ন। তবে রাস্তাটা আজ যেন বেশি নির্জন মনে হয় আমার। রাস্তায় একটা কুকুরের ও দেখা নেই। এক দিক থেকে ভালোই হয়েছে।এ ব্যাটারা থাকলে ডেকে-মেকে অস্থির করে দেয়। ফলে শিকার ও হাতছাড়া হয়ে যায়। আগে যে ক'বার এখানে এসেছি,কুকুরের জন্যে একই অবস্থা ঘটেছে। আজ অবশ্য সে চিন্তা নেই। আরও কিছুটা সামনে হেঁটে যায় মেয়েটি।তারপর মেয়েটি থমকে দাঁড়ায়।আমিও থেমে যাই........।
দু'পাশের ল্যাম্পপোস্টের,বেশির ভাগ গুলোতে লাইট নেই। বেশ একটা আলো-আঁধারি পরিবেশের মধ্যে এসে পড়েছি দু'জন। এখন আমার থেকে হাত পঁচিশ দুরে মেয়েটি।এই মুহুর্তে মেয়েটি আমার দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে আছে। রাতের নিয়ন আলোয় তাকে দেখতে পাচ্ছি আমি। মেয়েটি দুপাশে বার বার তাকায়। তারপর ব্যাগ থেকে ফোন টা বের করে,কাকে যেন ফোন করে। অস্পর্ষ্ট কথা কানে আসে।
এই উপযুক্ত জায়গা! এরকম সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। খুব সন্তর্পণে আরও কয়েক পা এগিয়ে যাই মেয়েটির দিকে। আরও তিন জন আসার কথা আছে। পকেট থেকে পিস্তল টা বের করি আমি।গুলি লোডেড পিস্তল। তারপর ট্রিগারে তর্জনী রাখি। রাস্তার পাশে একটা কাঁটা-লতার ঝোপ-ঝাঁড়।আমি তার আড়ালে সরে দাঁড়াই। একটু অপেক্ষা!
আবছায়া আলোয় তিনজন মানুষকে দেখতে পাই। টলতে টলতে মেয়েটির দিকে এগিয়ে আসে। মেয়েটি কে ঘিরে ফেলে।একজন মেয়েটির হাত ধরে। আরেক জন মেয়েটির বুকের উপর থেকে কাপড়ের আঁচল টা সরিয়ে দেয়। আমার আর সহ্য হয় না। আমি আরও একটু এগিয়ে যাই। মেয়েটির থেকে এখন আমি হাত দশ-বারো দুরে দাঁড়িয়ে আছি। মুহুর্তের মধ্যে এক ঝটকায় তিনজন কে ছিটকে ফেলে দেয় মেয়েটি। তারপর চিৎকার করে ওঠে, -"স্যার! শুট দেম।"
আমি ছিটকে বের হই ঝোঁপের আড়াল থেকে। পর পর তিনটে গুলির আওয়াজ হয়।অব্যর্থ নিশানা! তিনজনই উঠে দাঁড়াতে গিয়েও আবার লুটিয়ে পড়ে রাস্তার উপর। আমি ছুটে যাই মেয়েটির কাছে।বলি, -"ঐশী,তুমি ঠিক আছো তো?"
ঐশীর বুক ওঠা-নামা করছে। তার মানে ও এখনো হাঁফাচ্ছে ভয়ে।একটু দম নিয়ে বলে,-"হ্যাঁ স্যার।ঠিক আছি।" কথাটা শেষ করে মৃত একজনের পেটে লাথি মারে। আমি ওর পিট চাপড়ে কাছে টেনে নিই।মৃতদেহ তিনটের দিকে তাকাই।
রাস্তার উপর লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে।মৃতদেহের বুকের কাছে কান নিয়ে যাই।কোনো ধুকপুকানির শব্দ আসে না। উঠে দাঁড়াই।পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাই। একটা টান দিয়ে বলি,-"গুড জব ঐশী! অপারেশন তাহলে সাকসেস ফুল হল?"
ঐশী আমার দিকে তাকিয়ে একটা স্যালুট করে।বলে,-"ইয়েস স্যার!"
আমি বিরক্ত হয়ে বলি,-"তোমাকে কত বার বলেছি,শুধু আমরা দু'জন যখন থাকবো,তখন আমাকে স্যার বলবে না,আর স্যালুট করবে না!"
ঐশী হাসে।তারপর আমার হাত ধরে বলে,-"চলো,অনেক রাত হল। থানায় ফিরে আবার রিপোর্ট বানাতে হবে।"
আমি সিগারেট টা ফেলে দিয়ে বলি, -"হুম চলো।জানো ঐশী,এতগুলো এনকাউন্টার অপারেশান করেছি, কিন্তু আজ আমার সত্যি ভয় করছিল!"
-"কেন?"ঐশীর ভুরু কোঁচকায়।
-"কারন,আজ তোমাকেই বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিলাম!"
ঐশী আমার দিকে তাকায়।তারপর একটা হাত ধরে আমার। বলে,-" কিসের বিপদ!তুমি তো সাথে ছিলে।"
হাতের ঘড়িতে চোখ রাখি।রাত পৌনে এগারোটা বেজে গেছে। আমরা থানার পথ ধরি।
স্বদেশ কুমার গায়েন (২০১৬)
Comments
Post a comment