পুরুলিয়ার ছোট্ট স্টেশন।একটুখানির জন্যে ট্রেন টা মিস হয়ে গেল।উনিশ– কুড়ি বছর বয়স হলে এক ছুটে ট্রেন টা ধরে নিতাম কিন্তু,এই আটাশ বছরে আর ছুটতে ইচ্ছে হল না। বাধ্য হয়ে লাল কাঁকর বসানো প্লাটফর্মের একটা বেঞ্চের উপর এসে বসলাম। স্টেশন থেকে কিছু দুরে একটা প্রাইমারী স্কুলে পড়াই আমি,তাই এই স্টেশন খুব প্রিয় আমার। গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেল,দখিনের সির সির বাতাশ ঘর্মাক্ত মুখে যেন বরফের কুচি ছড়িয়ে দিচ্ছে।চা খেতে খেতে দূরের কালো শাল বন টাকে দেখছি।হঠাৎএকটি মেয়ের গলা— 'এই দীপ্ত '।
চমকে উঠলাম। আমার নাম ধরে কে ডাকল! পাশের বেঞ্চের দিকে তাকালাম,উনিশ – কুড়ি বছরের দুটি ছেলে মেয়ে বসে বেশ গল্প করছে। মেয়েটি বলল— দীপ্ত, কাল কিন্তু সিনেমা দেখতে যাব।
বুঝলাম,ঐ ছেলেটির নাম ও দীপ্ত। আমার ও কেমন ইচ্ছে করল দশ বছর আগে ফিরে যেতে।.....সোনালী শহুরে স্মার্ট মেয়ে। পড়াশুনা সূত্রে পরিচয়,বন্ধুত্ব,তারপর প্রেমে পড়া।খুব ভালবেসে ফেলেছিলাম,কিন্তু বলার সাহস হয়নি। বুঝতে পারতাম, ও আমাকে ভালবাসে– কিন্তু ওটা বন্ধুত্ব না ভালবাসা আজও আমি বুঝিনি।তারপর হঠাৎ চাকরী পেয়ে চলে এলাম এই লাল মাটির গ্রামে।ফিরে গিয়ে আর খুঁজে পায়নি,বাড়ি পালটে ফেলেছিল ওরা। কোনো ঠিকানা ও রেখে যায়নি। একরাশ কষ্ট নিয়ে ফিরে এসেছিলাম সেদিন।
প্লাটফর্মে ট্রেন ঢুকতেই উঠে পড়লাম।সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আজ আর সিটে গিয়ে বসতে ভাল লাগল না,দরজার কাছে দাড়িয়ে রইলাম।হঠাৎ পেছন দিক থেকে,একটা মেয়ে কন্ঠের আওয়াজ – দীপ্ত, এদিকে এস।
চমকে উঠে, পিছনে তাকালাম।– না,সেই ছেলে মেয়ে দুজন কে দেখলাম না।তবে কে ডাকল? মন টা খারাপ হয়ে গেল,ভিতরে এসে সিটে বসে পড়লাম। চোখ টা সামনের সিটে যেতেই, আমার বুকের ভিতর টা ধড়াস করে উঠল।– সোনালী! মাথায় লাল সিঁদুর, পরনে শাড়ি..একদম পালটে গেছে। বললাম– সোনালি, চিনতে পারছ?
আরে, দীপ্ত তুমি! অনেক পালটে গেছো..চিনতেই পারিনি।অনেকদিন পর দেখা হলে যা হয়। এরপর একটা বাচ্চা ছেলে এসে তার কোলে বসল। আমি বললাম– তোমার ছেলে?
হ্যাঁ...।
ছেলেটিকে কাছে টেনে নিলাম। একদম তোমার মতো দেখতে হয়েছে,সোনালী। জিজ্ঞেসস করলাম– কি নাম তোমার?
ছেলেটি বলল– দীপ্ত সেন।
আরও জোরে ঢাক্কা খেলাম আমি। মুখ তুলে চাইলাম সোনালির দিকে। সে একদৃষ্টে বাইরে তাকিয়ে আছে। ট্রেনের সেই হাল্কা আলোয় পরিষ্কার দেখতে পেলাম তার চোখ দুটি জলে ভরে উঠেছে। আমি আর কোনো কথা বলতে পারলাম না। ট্রেনের গতি কমে এসেছে,প্লাটফর্ম ঢুকছে ।সোনালী উঠে দাঁড়াল।বলল– দীপ্ত , আমাকে এবার নামতে হবে।
ট্রেন থামতেই সোনালী নেমে গেল। আমি আর বসে থাকতে পারলাম না,ছুটে গেলাম দরজার কাছে। এখনো দেখতে পাচ্ছি,ট্রেন গতি নিয়েছে– আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে একটা প্রেম কাহিনি ।
বিষন্ন মনে দরজার রড ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। শুধু চোখ থেকে চশমা টা খুলতেই একফোঁটা জল ট্রেন লাইনের কালো পাথরে মিশে গেল।
স্বদেশ কুমার গায়েন [২০১০]
Comments
Post a comment