বেশ কিছুদিন ধরে ছেলেটিকে লক্ষ্য করেছি চুপ করে মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে বা, বসে থাকতে। আজও যেমন বসে আছে। কালো সুট আর টিশার্ট পরনে। সব সময় যে দেখি তা নয়। তবে আমি যে কদিন বিকালে একটু হেঁটে বেড়াতে মাঠ মুখি হই, সে ক'দিন ছেলেটিকে মাঠে বসে থাকতে দেখি। ছোটেও না, হাঁটেও না। শুধু মাঠের সবুজ ঘাসের উপর বসে থাকে। কখনো বা, দাঁড়িয়ে থাকে। কতই বা বয়েস হবে, তেইশ কি চব্বিশ। রোগা পাতলা চেহারা, আধ ফর্সা গায়ের রঙ, জোড়া ভুরু, হালকা কালো চুল মাথায় ছেলেটির। চোখে একটা অদ্ভুত আকর্ষন আছে। উচ্চতা মাঝারি। পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির কাছাকাছি। মুখটা সব সময় ফ্যাকাশে। দেখলে মনে হবে অনেকদিন আগে হাসি ভুলে গেছে।
আমার কাজ বলতে তেমন কিছু নেই। এই বিকেলে মাঠে এসে একটু শরীর চর্চা করা, ছেলেদের খেলা দেখা। তারপর সন্ধ্যেবেলার একটু হাওয়া মেখে ঘরে ফেরা। আর অবসর সময়ে ফেসবুকে লেখালেখি করা। গল্প লিখি। কিন্তু আমি সেটা কখনই মনে করি না। আমার ফেসবুকের বন্ধু বান্ধব,দাদা-দিদি রা সেরকমই বলে। বেশ কিছুদিন ধরে মনের অবস্থাটা খারাপ যাচ্ছিল। কোনো গল্পই আসছিল না মাথায়। মাঝে মাঝে এমন হয় আমার। কোনোদিন, একসাথে অনেক গল্পরা এসে জড়ো হয় মাথার মধ্যে, আবার কোনোসময় গল্পের দেখা পাওয়া যায় না। তাই ছেলেটির সাথে আমার আলাপ করতে ইচ্ছে হল। এরকম বিষন্নভাবে বসে থাকা মানুষ দের কাছে গল্পরা জমা হয়ে থাকে। যদি কথা বলতে বলতে দু'একটা গল্পের প্লট খুঁজে পাই।তাই আজ আর হাঁটাহাঁটি করলাম না। ধীরে ধীরে ছেলেটির পাশে গিয়ে বসলাম।
এখনো পুরোপুরি সন্ধ্যে নামেনি। সামনের বড় তিনতলা বাড়ির ছাদের উপরে, সূর্যটা স্থির হয়ে আছে। শান্ত রোদ। এলোমেলো হাওয়া। ক্লাবের ছেলেরা সব ফুটবল খেলছে মাঠে। একটা হই হট্টোগোল, চিৎকার চেঁচামেচি। আমরা মাঠের পূর্ব দিক টাতে বসে আছি। এদিকটা তুলনামূলক ভাবে একটু শান্ত। ছেলেটির পাশে গিয়ে বসতেই, আমার দিকে চোখ তুলে একবার তাকালো। সত্যিই চোখের একটা অদ্ভূত আকর্ষন আছে। তারপর আবার সেই এলোমেলো ফুটবল খেলার দিকে চোখ ফেরালো। আমিই কথা শুরু করলাম। বললাম, -" তোমাকে রোজ মাঠে এসে বসে থাকতে দেখি। খেলা-ধূলা করো না? "
আমার দিকে এবার তাকায় ছেলেটি। ভালো ভাবে দেখে। তারপর বলে,-" এক সময় করতাম, এখন আর ভালো লাগে না।"
-" তোমাকে তো দেখে এখানকার মনে হয় না। নাম কি তোমার? "
-" না, আমি এখানকার নয়। কর্মসূত্রে এখানে আছি।..স্বদেশ কুমার গায়েন।" সংক্ষেপে বলল ছেলেটি।
-"ওহ। আচ্ছা, তোমাকে তবে শুধু স্বদেশ বলে ডাকবো আমি।"
কিছু বললো না সে। আমার দিকে তাকালো। অগত্যা আমি প্রশ্ন করলাম,-"তো, কি কাজ করা হয়?"
একজন অপরিচিত কেউ আগবাড়িয়ে আলাপচারিতা শুরু করলে, বিপরীত দিকের মানুষটা ঠিক যেভাবে ভুরু কুঁচকে তাকায়, ছেলেটিও ঠিক সেই ভাবে আমার দিকে তাকালো। তারপর বলল,-" রেলে চাকরী করি। ডি গ্রুপের।"
আমি হেসে বললাম,-" ওহ তাই নাকি! আমার ও এক বন্ধুও রেলে, ডি গ্রুপের চাকরী করে। তো, কোন ডিপার্টমেন্ট ?"
-" ওভার হেড ইকুইপমেন্ট জানেন? সহজ করে বলি, ইলেক্ট্রিকাল।"
ও কি বিরক্ত হচ্ছে? হলে হোক, আমাকে বিরক্ত হলে চলবে না। -" ওহ! অতশত বুঝিনা বাপু। তো, কি কাজ করতে হয় তোমার? " হাসলাম আমি। আসলে স্বদেশ ছেলেটির সাথে গল্প করতে মন্দ লাগছে না। তাই একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছি।
আমার প্রশ্ন শুনে স্বদেশ এবার আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে মাঠের দিকে রাখলো। তারপর শান্ত গলায় ফ্যাকাসে হাসি হেসে বলল,- " তেমন কিছু নয়। লাইন স্টাফ, তাই দিন-রাত বেশির ভাগ কাজ রেল লাইনে গিয়ে করতে হয়। এছাড়া হাতুড়ি পেটাই, কাটার দিয়ে ইলেক্ট্রিকের তার কাটি, তেলের ড্রাম, লোহার রড, আর্থিং রড, ইলেক্ট্রিক তার, ল্যাডার, আরও নানা রকম জিনিষ পত্র বয়ে নিয়ে যাই। মাঝে মাঝে ডাক পড়লে, ডিপার্টমেন্টর বড় অফিসারের ঘরের বাজার করে দিয়ে আসতে হয়। কখনো বা, তার ঘরের সরঞ্জাম এক কোয়ার্টার থেকে আরেক কোয়ার্টারে বয়ে নিয়ে যেতে হয়...এই সব আর কি।"
কি বলবো, বুঝতে পারলাম না। রেলের কিছু কাজ এমন, সে আমার বন্ধুর থেকে জেনেছিলাম। কিন্তু আমার বন্ধুটা এসব কাজ করে না। জিজ্ঞেস করলাম,-" তোমার আসল বাড়ি কোথায়?"
আমার প্রশ্নের উত্তরে, স্বদেশ পালটা প্রশ্ন রাখলো,-" আপনি কি করেন, সেটাই তো জানা হল না? "
-" আমি! আমি তেমন কিছু করি না। এই লেখালেখি করি একটু।" হেসে প্রশ্নের উত্তর দিলাম।
-" ওহ! তার মানে আপনি লেখক!"
-" না, ওসব নই। কোথাও জায়গা না পেয়ে ওই, ফেসবুকে লেখালেখি করি।"
-" যাই হোক, লেখেন মানেই আপনি লেখক। তো, কি লেখেন গল্প না, কবিতা?"
-" মূলত গল্প।"
-"বাহ! খুব ভালো । আমার গল্প পড়তে ভালো লাগে।"
-" যাক, একজন গল্প পাঠকের সাথে পরিচয় হওয়া গেল।"
-" একটা গল্প লিখবেন? আমার জীবনের গল্প।"
এ তো মেঘ না চাইতেই জল! যে উদ্দেশ্যে আমার ছেলেটির সাথে পরিচয় করা, সেই উদ্দেশ্য ছেলেটি নিজেই পূরন করে দিচ্ছে। হেসে বললাম, -" লিখতে পারি। তবে তোমার প্রেম-ট্রেম এর গল্প বলো না যেন। কারন এত বেশি প্রেমের গল্প লিখেছি যে,আমার নিজের জীবন থেকেই প্রেম নামক জিনিষ টা পালিয়েছে।"
হো হো হো হেসে পড়লো স্বদেশ। তারপর বলল,-" না । প্রেমের গল্প নয়।"
-" বেশ। তবে গল্পটা যেন দু:খের না হয়।"
-" না, সেটাও হবে না। আমার সবথেকে আনন্দ পাওয়ার গল্প। খুশি হওয়ার গল্প।
-" বাহ! তবে তো ভালোই হবে। কিন্তু আজ আর শোনা হবে না। সন্ধ্যে হয়ে এল, আমাকে যে ফিরতে হবে। কাল আসবে তো?"
স্বদেশ দু'পাশে মাথা নাড়ালো। তার মানে হ্যাঁ।
-" আচ্ছা, কাল এসো তবে। আজ চলি।"
সন্ধে নেমে গেছে অনেক আগেই। আসে পাশের বাড়ি, স্ট্রিট লাইট গুলো জ্বলে উঠেছে। আমি উঠে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম।
পরদিন মাঠে গিয়ে দেখি, আগে থেকেই এসে বসে আছে স্বদেশ। পরনে আজ জিনস আর টি- শার্ট। চোখ- মুখ দেখে বোঝা যায়, সবে ঘুম থেকে উঠে এসেছে। পাশে গিয়ে বসলাম আমি। আমার দিকে তাকালো স্বদেশ। বলল,-" বসুন।"
আমি হসে বললাম,-" তোমার ডিউটি কখন? আজ ছুটি নাকি?"
-" না। রাতে ডিউটি চলছে।"
-"ওহ। তাহলে এবার শুনি তোমার গল্প।"
স্বদেশের কথা:
তখন ২০০৮ সাল। মাধ্যমিক পাশ করার পর আমি বাড়ি ছেড়ে ক্যানিং এ চলে এলাম। ছোট্টো একটা মেস বাড়িতে। পড়াশুনার জন্যে। স্থানীয় এক স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলাম। অনেকটা বাড়ি আর নিজের মতে। এটা আমার জীবনের প্রথম ভুল। সেরকমই মনে করি আমি। আসলে কি জানেন, কোনো কাজে নামার আগে সেই জিনিষ টা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারনা রাখা দরকার। তাছাড়া সেই বিষয়ে কতটা আগ্রহী, সেটাও বিবেচনা করা উচিত। নইলে গোলমাল টা পরে বাঁধে। সেটা আমি করিও নি। খারাপ স্টুডেন্ট ছিলাম না। মাধ্যমিকে স্টার মার্ক। সবাই বলল, সায়েন্সে ভর্তি হও; ভবিষ্যৎ আছে। ভর্তি হয়েও গেলাম । আসলে ভবিষ্যৎ জিনিষ টা, সায়েন্স, আর্টস, কমার্স দিয়ে মাপা ঠিক নয়। এটা ঠিক যে, খুব তাড়াতাড়ি রোজগেরে হতে, অনেকেই সায়েন্স, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়রের পথ বেছে নেয়। ক'জন ভালোবেসে পড়াশুনা করে আমি জানি না।
তাই আমিও লেগে পড়লাম সেই রেসে। ভর্তি হয়ে গেলাম সায়েন্সে। কিন্তু আসল ভবিষ্যৎ সেটাই, যেটা তোমাকে শান্তি দেয়। যেটা তোমাকে ভালো থাকতে দেয়। খুশি রাখে।মুখে হাসি এনে দেয়। সেটাই সাফল্য। সেটাই ভবিষ্যৎ।
যাইহোক মূল গল্পে ফিরি। মোটামুটি চলছিল আমার জীবন। কিন্তু হঠাৎ এক মেয়ের প্রেমে পড়ে পড়াশুনায় ফাঁকি মারতে শুরু করে দিলাম। আপনি যেহেতু প্রেমের গল্প চান না, তাই সে বিষয়ে কিছু বললাম না। তবে সায়েন্স এমন একটা বিষয়, যেখানে বোধহয় কোনোদিন ফাঁকি মারা চলে না। শুধু সায়েন্স বলি কেন, যে কোনো বিষয়ে ফাঁকি মারতে নেই। তাহলে তার ফল টা হয় ভয়ঙ্কর। আজ সেটা বুঝতে পারি আমি। তবুও ফাঁকি মেরেই কোনোরকমে ষাট শতাংশের উপরে নাম্বার নিয়ে পাশ করে গেলাম। মান রক্ষা হল সবার কাছে। পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজন সবার কাছে। নইলে সবাই হাসাহাসি, বিদ্রুপ করতো আমাকে নিয়ে। তখনকার মতো তাদের হাসি থেকে বেঁচে গেলেও, হাসির খোরাক হয়ে উঠলাম আমার পরের সিদ্ধান্তে। সে গল্পই করবো এবার।
সবাই জানে আমি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। সত্যিই আমি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর একবছর পড়েছিলাম কলেজে। এই ছোট্টো মফস্বলের ছেলে-মেয়েরা বেশির ভাগ সবাই কলকাতার কলেজে পড়াশুনা করে। কিন্তু আমি ক্যানিং এর একটা স্থানীয় কলেজে ভর্তি হলাম। জার্নিতে বরাবরই ভয় আমার। আর কিছুটা অন্তর্মুখী ও বটে। অনেকটা সে কারনেই কলকাতা না যাওয়া। আর আগের থেকে আরও বড় ভুল টা করে বসলাম। ফিজিক্স অনার্স নিয়ে ভর্তি হলাম। জীবনে সঠিক গাইড, কাউন্সিলিং এর অনেক প্রয়োজন আছে সেটা আজ মনে মনে অনুধাবন করি আমি। ফিজিক্সের অপটিকস এর বই পড়তে গিয়ে আলো নয়, অন্ধকার দেখলাম আমি। বুঝতে পারলাম খুব বড় ভুল করতে চলেছি । পাশ হয়তো করে যাব কিন্তু তাতে কোনো লাভ হবে না। কিছু শিখবো না আমি। তাই সিদ্ধান্ত টা আমাকে নিতেই হল। সবার বিরুদ্ধে গিয়ে আমি একাই সিদ্ধান্তটা নিলাম। মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিলাম। বাড়িতে বললাম,-" আমি বিজ্ঞান নিয়ে পড়বো না। ভালো রেজাল্ট হবে না। বাংলা নিয়ে পড়বো।"
বাংলা সাবজেক্ট টা বরাবরই আমার প্যাশন, ভালোলাগা, ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার কাছে ফিরে গেলাম আমি। একটা জিনিষ বুঝতে পারি, কোনো জিনিষের প্রতি ভালোলাগা, ভালোবাসা না থাকলে সেটা নিয়ে বেশিদূর এগোনো যায় না। আর সাফল্য? সাফল্য তো সাফল্যই হয়, সে আর্টস নিয়ে পড়ো বা, সায়েন্স নিয়ে পড়ো অথবা, কমার্স নিয়ে পড়ো। বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা,জানার ইচ্ছে, শেখার ইচ্ছে, আর তোমার লক্ষ্য ঠিক থাকলে, যেকোনো বিষয়ে তুমি সফল হবে। আজ কাল, মা- বাবা দের একটা জিনিষ বেশ লক্ষ্য করি, পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুলো মার্কশিট হাতে নিয়ে সবার একটাই প্রশ্ন- এই তোমার ছেলে অঙ্কে কত পেয়েছে? এই তোমার ছেলের ইংরাজীতে কত হল? এই জানো, আমার মেয়ে বিজ্ঞানে লেটার মার্ক পেয়েছে,..আমার ছেলে ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছে।সবাই নম্বর নিয়ে ব্যস্থ। কেউ এটুকু জানতে চায় না যে, আমার ছেলে বা মেয়ে কতটা জানে? কতটা শিখেছে? কি দরকার জানার, শেখার? নাম্বার পেলেই হল। আমি তো শুধু নোট মুখস্ত করেই বিজ্ঞান বিভাগে বিভাগে ষাট শতাংশের উপরে নাম্বার পেয়েছি। সত্যি কি কিছু শিখেছিলাম আমি? কিছুই শিখেনি। আজ বুঝি নাম্বার টাই জীবনের সব কিছু নয়।
আমার কথা শুনে বাবা বলল,-" কি! বাংলা! সবাই শুনলে হাসবে। যা পারিস রেজাল্ট কর। বিজ্ঞান নিয়েই পড়। পাশ করলেই হবে।"
কারও কথা শুনলাম না আমি। ছেড়েই দিলাম পড়া। কিন্তু সে বছর আর বাংলা নিয়ে ভর্তি হতে পারলাম না। আবার এক বছর অপেক্ষা করে বাংলা অনার্স নিয়ে ভর্তি হলাম। সত্যিই এবার আমাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করলো। আমার আত্মীয়-স্বজন, আমার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব। সবার কাছে অসহ্য হয়ে উঠলাম। সব থেকে খারাপ লেগেছিল, এই রকম অবস্থায় আমি আমার পরিবারের মানুষ গুলো কে কাছে পাই নি। শুরু হল নিরানব্বই জন মানুষের বিরুদ্ধে আমার একার লড়াই। আমি যে খারাপ স্টুডেন্ট নই, সেটা প্রমান করার লড়াই।
এ পর্যন্ত বলে স্বদেশ থামলো। একটা লম্বা নিশ্বাস নিল।
-" ইন্টারেস্টিং।" আমি বললাম। " বেশ ভালো লাগছে শুনতে। শেষ টা জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আজ যে রাত হয়ে এল।"
-" হ্যাঁ। আজ আমারও উঠতে হবে। ডিউটি আছে আবার। কাল আসবেন, কাল বলবো তবে।" স্বদেশ বলল।
উঠে পড়লাম দু'জন। আজও সন্ধ্যা নেমে গেছে অনেক আগেই। পরিষ্কার আকাশে আধফালি কুমড়োর মতো চাঁদ। তার থেকে মৃদু আলো নেমেছে আমাদের মাথার উপর। বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম দু'জনই।
স্বদেশের গল্প আমাকে টানছিল। বাড়ি এসে অনেক চিন্তা-ভাবনা শুরু করে দিলাম। কিভাবে এই গল্পের প্লট টা সাজানো যায়। সত্যিই অনেক দিন বাদে, একটা অন্যরকম ইন্টারেস্টিং ঘটনা শুনছি। কেন জানি না, ওর গল্পের শেষ পরিনতি খুব জানতে ইচ্ছে করছিল। মনে মনে ভাবছিলাম, ও যেন জিতে যায় এই লাড়াই এ। তাই পরের দিন গল্পের টানে টানে আগে ভাগেই মাঠে গিয়ে হাজির হলাম। তখনও আসেনি স্বদেশ। কিছুক্ষন পর এলো। তারপর আমার পাশে বসে, হেসে বলল,-" আজ একটু দেরী হয়ে গেল। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।"
আমি হেসে বললাম,-" ঠিক আছে। এবার তাহলে শোনা যাক।"
স্বদেশের কথা:
২০১১ সাল। বিজ্ঞান ছেড়ে বাংলা অনার্স নিয়ে ভর্তি হলাম আমি। অনেক আগেই সবাই ছি ছি, থু থু করেছিল। কিন্তু এটা জানতাম, একটা চাকরী, অথবা ভালো রেজাল্ট করলে এদের সবার মুখ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি আমার মন খারাপের কারন হয়ে দাঁড়ালো। তবুও আশা ছাড়লাম না।
এর আগের একটু ঘটনা বলি। আঠেরো বছর বয়েস পার হতেই রেলের গ্রুপ ডি পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপ করলাম আমি। চাকরী পাওয়ার আসায় নয়। ঘুরতে যাওয়ার জন্যে। রেলের পরীক্ষা দিতে গেলে নাকি, ট্রেনে যাতায়াতের পয়সা লাগে না। তাই আমার মেসের সবাই মিলে ফর্ম ফিলাপ করলাম। মাঝের একটা বছর পড়া ছেড়ে দিয়ে নানা রকম বই পড়তে শুরু করলাম। পড়ার নেশা আমার ছোটো থেকে ছিল। এই রকম অবস্থায় আমাকে কোনো মানুষ মোটিভেট করেনি। মোটিভেট করেছিল একটা সিনেমা। "থ্রি ইডিয়টস"। বার বার একটা কথা মনে পড়তো, বাচ্চা,কাবিল বানো কামেয়াবি তো ঝক মারকে পিছে আয়েগি।...সাকসেস কে পিছে মত ভাগো..... এক্সেলেন্স কে পিছে ভাগো।জানি, সিমেনা আর বাস্তব এক নয়। তবুও এই কথা গুলোই আমার জীবনের মূল মন্ত্র। এক জেদ আমাকে চেপে ধরলো। সব রকম বই পড়তে শুরু করলাম। জানার জন্যে। শেখার জন্য। সাথে, চাকরীর পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কেমন হয় সেটাও দেখতে শুরু করলাম। পড়তে পড়তে মনে হতো, আমি সব বিষয় সম্পর্কে জানবো। যে যেটা জিজ্ঞেস করবে, সেটা সম্পর্কে যেন বলতে পারি। যেটা পরে আমার চাকরী পাওয়ার ক্ষেত্রে কাজে দিয়েছিল।
এবার কলেজের কথায় আসি। এই একটা বছর আমি প্রায় নিয়মিত কলেজ গেলাম। গ্রাম্য কলেজ। তবে বেশ সুন্দর পরিবেশ। গাছ-গাছালি তে মোড়া। পরিষ্কার- পরিছন্ন। আমার মনে হয় যারা কম নাম্বার পায়, বা বড় বড় কলেজে অ্যাডমিশন পায় না- তাদের জন্যেই এই সব কলেজ তৈরী। তবুও তো ভালো, সবাই কলেজে পড়ার সুযোগ পায়।প্রথম দিনই কলেজে গিয়ে বুঝতে পারলাম,পড়াশুনা টাই কম হয় এখানে। বাকি আর সব কিছু হয়। তা মন্দ নয়। আর এখন কলেজের পড়াশোনা মানেই ভালো টিউসান, নোট, সাজেসান নির্ভর। সুতারং কলেজে আসার তেমন কোনো দরকার পড়ে না।
ক্লাসে যেমন থাকে আর কি, নানা ধরনের স্টুডেন্ট। কেউ সিরিয়াস, কেউ হাসি- মজা করতে ভালোবাসে, কেউ আবার মেয়েদের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বেশ কিছু ভালো স্টুডেন্ট ছিল। তারা সব সময় বই নিয়ে থাকতো। ডিপার্টমেন্টের স্যার, ম্যাডাম দের সাথে তাদের পরিচয় ও ছিল খুব ভালো। এটা মনে হয় সব ক্লাসেই থাকে। তাছাড়া ক্লাসে এসে স্যার, ম্যাডাম রা বুঝে যেত কে কেমন স্টুডেন্ট। ছোটো থেকেই আমি খুব অন্তর্মুখী। কথা বলি কম। খুব তাড়াতাড়ি মানুষের সাথে মিশে উঠতে পারি না। স্যার- ম্যাডাম দের সাথে কোনোদিন কথাও বলি না। তাদের কে প্রশ্ন জিজ্ঞেস ও করার সাহস পেয়ে উঠি না। নিজের মতো সময় কাটে। কিছু নতুন ছেলের সাথে পরিচয় হয়েছিল, তাদের সাথেই একটু আধটু কথা বলতাম।
একজন শিক্ষক ক্লাসে খুব ভালো বাংলা পড়াতেন। তার পড়ানোর স্টাইল টাই ছিল চমকে দেওয়ার মতো। মন্ত্র মুগ্ধের মতো ক্লাসে বসিয়ে রাখতো। কলকাতা সহ অনান্য জায়গায় টিউশন পড়াতেন তিনি। ক্লাসের বেশির ভাগ ছেলে মেয়ে তার কাছে টিউশন পড়তে যেত। আরও অনেকেই কলকাতার ভালো ভালো টিচার দের কাছে পড়তে যেত। যেহেতু নোট নির্ভর পড়া, তাই আমি স্থানীয় একজনের কাছে গেলাম পড়তে। দু'দিন গিয়েছিলাম মাত্র। তারপর আর গেলাম না। টিউশন ছেড়ে ছিলাম একটাই কারনে। আজ আর সে কথা বলতে লজ্জা নেই, টাকার কারনে টিউশন ছাড়লাম । এই একটাই কারনে আমি আমার কোনো ইচ্ছে, শখ পুরন করতে পারি নি। তবুও আমি তার জন্যে কোনোদিন দু:খ করি নি। বাবা- মা কে দোষারোপ করি নি। সবার জীবনে সব কিছু থাকে না। বাড়ি থেকে যা টাকা আসতো, তাই দিয়ে থাকা-খাওয়া, হাত খরচ চলতো। যদিও তারা কষ্ট করে হলেও, হয়তো বেশি টাকা পাঠিয়ে দিত কিন্তু এই ঘটনা ঘটানোর পর তাদের কাছে আর টাকা চাইতে পারে নি। আত্মসন্মানে লাগছিল। তাই শুরু করলাম আরেক টা লড়াই। নিজেই নোট তৈরী করা। ঠিক করলাম, আমি নিজেই নোট তৈরী করবো। মনে মনে, অজান্তেই কখন যেন একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে বসলাম।
মেসের একজন দাদা বাংলা নিয়ে পড়েছিল। তার থেকে পুরানো নোট জোগাড় করে পড়ে পড়ে বুঝলাম, কি ভাবে উত্তর তৈরী করতে হবে। নিয়মিত কলেজে ক্লাস করতাম। স্যার, ম্যাডাম দের আলোচনা শুনতে লাগলাম। একটু একটু বুঝতে পারলাম সব। তারা সাজেসান দিতেন। কোন প্রশ্ন গুলো পরীক্ষায় আসবে, কোন গুলো বেশি গুরুত্বপূর্ন। সব খাতায় লিখে রাখতে শুরু করলাম। কি বা উপায় ছিল আমার? এই ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। তারপর শুরু হল প্রশ্ন অনুযায়ী আমার নোট তৈরী করা। সেই মুহুর্তে আমার কাছে যেন লড়াই ছিল এটা।
আড্ডা, গল্প এসব আমি সবার সাথে করতে পারি না। লাইব্রেরীতে যাওয়া শুরু করলাম। ক্লাসের থেকে লাইব্রেরীর সাথে যেন আমার সখ্যতা বেড়ে গেল। লাইব্রেরীতে দু'ধরনের কার্ড ছিল। একটা কার্ডে বই নিয়ে লাইব্রেরীর ভেতর বসে পড়তে হত। আরেকটা কার্ডে বই নিয়ে বাড়িতে যাওয়া যেত। আমি দু'টো কার্ডেই বই তুললাম। লাইব্রেরী বসে পড়তে শুরু করলাম বেশির ভাগ দিন। দরকারী জিনিষ খাতায় টুকে নিতাম। আর অন্য কার্ডে বই তুলে বাড়িতে নিয়ে আসতাম। লাইব্রেরী তে পরীক্ষা সম্বন্ধীয় যত রকম রেফারেন্স বই ছিল, সব বই নিতে শুরু করলাম। তার পর সব বই থেকে তথ্য সংগ্রহ করে নিজের মতো করে প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর তৈরী করলাম। তার পর শুরু হল আমার সেই নোট মুখস্ত করা। এই একটা বিদ্যায় আমি খুব পারদর্শী ছিলাম।
ভয়টা তখন পায়নি। ভয় পেলাম প্রথম বর্ষের পরীক্ষার ঠিক আগে। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেলো। হাত-পা কাঁপতে শুরু করলো। সবার কাছে ভালো ভালো, অভিজ্ঞ টিচার দের নোট। আর আমার? নিজের তৈরী করা উত্তর। যারা খাতা দেখবে, তারা আমার উত্তর পছন্দ করবে? এই ভয়টা আমার মন কে ছেয়ে ধরলো। নিজের উপর সমস্ত বিশ্বাস হারিয়ে ফেললাম। এবার আমার মনে হতে লাগলো আমি বোধহয় ঠিক করি নি এটা। টিউশন পড়ে, নোট নিলে বোধহয় ভালো হত। এত টেনশন থাকতো না। তবুও প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় বসলাম। একটা জিনিষ খেয়াল করতাম, যতই নোট মুখস্ত করি না কেন, পরীক্ষায় খাতায় লেখার সময় হুবুহু নোট উগরে দিতে কোনোদিনই পারতাম না। কোথা থেকে যেন নতূন নতূন ভাষা এসে ঝুটতো আমার মনে। আর উত্তর টাও নিজের ভাষায় তৈরী হয়ে যেত। এভাবেই একটা ভয় নিয়ে আমার পরীক্ষা শেষ হল।
এতদূর পর্যন্ত এসে স্বদেশ থামলো। আমি অধৈর্য হয়ে বললাম,-" থামলে কেন? বলো, শেষ পর্যন্ত কি হল? সত্যিই অন্যরকম ইন্টারেস্টিং তোমার গল্প।
-" প্রায় শেষের পথে আমার কাহিনি। শেষ টা শুনুন তবে। "
-" বলো।"
স্বদেশের কথা :
পঞ্চাশ শতাংশ নাম্বার রাখতে পারলেই আমি খুশি।তার থেকে বেশি চাহিদা কোনোদিন ছিল না আমার। কিন্তু নিজের নোটের উপর সেই ভরসা ও পাচ্ছিলাম না। ভয় শুধু একটাই, যদি আমার উত্তর পছন্দ না হয়!
পরীক্ষা শেষ হয়েছিল অনেক আগেই। মাস চারেক পর তার রেজাল্ট বেরুলো। জানেন, এতটা আশা আমি কোনোদিন করি নি। ইন্টারনেটে রেজাল্ট দেখতেই চমকে উঠলাম। তেষট্টি শতাংশ নম্বর এল দুই পেপার মিলিয়ে।
এতটা খুশি হয়েছিলাম সেদিন, আমি আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না। আর কোনো কিছুতেই আমি খুশি হয় নি। সেদিন মন টা নিজের অজান্তেই খুশিতে ভরে উঠেছিল। কিন্তু বিশ্বাস করুন, তেষট্টি শতাংশ নাম্বার পেয়ে ছিলাম বলে,আমি খুশি হয় নি। খুশি হয়েছিলাম, যারা খাতা দেখেছেন, তারা আমার তৈরী করা উত্তর পছন্দ করেছে, এটা ভেবেই। কিন্তু এর পরেও যে চমক বাকি ছিল আমার জন্যে। পরদিন কলেজে যেতেই বুঝতে পারলাম সেটা। ডিপার্টমেন্টের মধ্যে সব থেকে বেশি নাম্বার পেয়েছি আমি। সবাই হতবাক। কেউ আমাকে জানেনা, চেনে না। কেউ ভাবিও নি কোনোদিন আমি এরকম একটা রেজাল্ট করবো। স্যার, ম্যাডাম রা পর্যন্ত আমাকে দেখেনি। একজন পরিচিত বন্ধু বলল,-" আরে ভাই, স্যার- ম্যাডাম রা বলছে, স্বদেশ কুমার গায়েন ছেলেটা কে? কলেজে আসতো নিয়মিত?...তোর তো খোঁজাখুজি শুরু করে দিয়েছেন তারা।"
আরেকজন বন্ধু বলল,-" আরে কয়েকজন মেয়ে জিজ্ঞেস করছিল, এই স্বদেশ ছেলেটা কে রে?".....অনেকে আবার জিজ্ঞেস করলো, -" তুই কার কাছে টিউশন পড়তিস রে?"
আমি হাসলাম। খুব খুশি লাগছিল আমার। মনে হল, আমি হারিয়ে যাইনি। আমার কাছে আমি জিতে গেছি। তারপর মার্কশিট নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
এবার কিছুক্ষন থামলো স্বদেশ। বড় করে একটা দম ছাড়লো।একটা অশ্রু লক্ষ্য করলাম তার চোখের কোনে। আনন্দ না, বেদনার আমি বুঝলাম না। অনেক সময় মানুষ তার সুখের স্মৃতি মনে করতে করতে আনন্দে চোখে জল এনে ফেলে। কিন্তু এটা কিসের জল আমি বুঝতে পারলাম না।
আমি বললাম,-" বাহ! দারুন তোমার গল্প। আমার খুব ভালো লেগেছে। সত্যি ওটা তোমার খুশির মহুর্ত একটা। কিন্তু তারপর? তারপর কি হল? সবাই খুঁজে পেল তোমাকে?"
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ফ্যাকাসে হাসি হেসে স্বদেশ বলল,-" না, আমাকে আর কেউ খুঁজে পায় নি।"
-" কেন!" বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন রাখলাম।
-" এর কিছুদিন পর, চাকরীর ফিজিক্যাল টেস্ট, মেডিকেল পরীক্ষায় ব্যস্থ হয়ে পড়লাম আমি। তারপর চাকরী পেয়ে চলে গেলাম খড়গপুর।"
-" আর পড়াশোনা করো নি? "আমি আরও অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।
-" না। আর করতে পারি নি। চাকরী করতে করতে রেগুলার পড়া যায় না। আর নিজের রেস্টের টাইম ই পেতাম না, তো আর পড়া-শুনা! মনটাই ভেঙে গেল।...এখন এই হাতুড়ি পেটাই, তেলের ড্রাম, লোহার রড, ল্যাডার বয়ে নিয়ে যাই, অফিসার দের বাজার করে দিই।"
শেষ কথা গুলো বলতে গিয়ে যেন স্বদেশের গলা ধরে এল। সেই সাথে কিছুটা বিদ্রুপ।কথা শেষ করে উঠে পড়লো সে। তারপর হেসে বলল,-" কবে লিখবেন আমার গল্প?"
আমি হতবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটু আগে মনে হচ্ছিল, কোনো সিনেমার চিত্রনাট্য শুনছি। কিন্তু এখন মনে হল বাস্তব কত ভয়ঙ্কর। মানুষ কে কোথা থেকে কোথায় এনে ফেলে।অজান্তেই স্বদেশের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ফেললাম,-" লিখবো,দু'একদিনের মধ্যে।"
তারপর আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘরের পথ ধরলো স্বদেশ। সূর্য ডুবে গেছে অনেক আগেই। পরদিন সকালে আবার দেখা দেবে। কিন্তু এই মুহুর্তে আমার সামনে থেকে যে ছেলেটা মাঠের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, তার মনে যে সূর্য ডুবেছে-সেটা হয়তো আর কোনদিন উদয় হবে না।
স্বদেশ কুমার গায়েন (ডিসেম্বর, ২০১৬)
Comments
Post a comment